দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় টাকা পাঠানোর প্রচলিত ও জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক। টাকার পরিমাণ বেশি হলে ব্যাংক ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতার বিষয় তো আছেই। এখন পর্যন্ত ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর খরচই সবচেয়ে কম। কোনো কোনো ব্যাংকে এমনকি খরচও লাগে না।
কিন্তু কম পরিমাণ টাকা পাঠানোর জন্য জনপ্রিয় মাধ্যম এখন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)। বিকাশ, রকেট, নগদ, শিওর ক্যাশ ইত্যাদির মাধ্যমে যে কেউ দেশের যেকোনো প্রান্তে টাকা পাঠাতে পারেন। খরচ প্রতি হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা। নগদ খরচ নিচ্ছে এখন হাজারে ভ্যাট ছাড়া ৯ দশমিক ৯৯ টাকা।
এবার আসা যাক মূল বিষয়ে। ব্যাংক ছাড়া দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাঠানোর যে উপায়গুলো রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে টাকা পাঠানো যায় ডাকঘরের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের এই সেবার নাম ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস (ইএমটিএস)। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হয় বলে একে মোবাইল মানি অর্ডার সার্ভিসও বলা হয়।
ইএমটিএসের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যেই দেশের যেকোনো প্রান্তে টাকা পাঠানো খুবই সহজ। গ্রাহকের ঠিকানা যা–ই হোক না কেন তিনি দেশের যেকোনো ডাকঘর থেকে টাকা পাঠাতে পারবেন, তুলতেও পারবেন। কমিশন বা খরচ প্রতি হাজারে ৫ টাকা। তবে ব্যতিক্রম শুধু এক হাজার টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে। এক হাজার টাকা পাঠানোর খরচ ১০ টাকা। পরে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাজার ৫ টাকা খরচ। টাকা পাঠানোর পর প্রেরকের মোবাইলে একটি পিন নম্বর যায়, যা প্রেরক ছাড়া আর কেউ জানতে পারেন না। প্রেরক একটি পেইড মেসেজ পান, যার মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন টাকা পৌঁছেছে।
ইএমটিএসের মাধ্যমে দুস্থ বয়স্ক, রোহিঙ্গা ভাতা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যেসব সেনাসদস্য দেশের বাইরে মিশনে রয়েছেন, তাঁদের বেতন-ভাতা ইএমটিএসের মাধ্যমে তাঁদের পরিবার-পরিজনের কাছে দেওয়া হচ্ছে।
২০১০ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী ইএমটিএসের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন, যা চালু হয় একই বছরের ৫ মে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগে ২ হাজার ৭৫০টি পোস্ট অফিসে এ সার্ভিস চালু রয়েছে। দেশের সব জিপিও, জেলা শহরে অবস্থিত সব ডাকঘর, সব উপজেলা ডাকঘর, সাব পোস্ট অফিস, গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ পোস্ট অফিসের নিকট এই সেবা পাওয়া যায়। কিছু পার্বত্য এলাকা বাদে সারা দেশই এই সেবার আওতায় রয়েছে।
ইএমটিএসের মাধ্যমে দুস্থ বয়স্ক, রোহিঙ্গা ভাতা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যেসব সেনাসদস্য দেশের বাইরে মিশনে রয়েছেন, তাঁদের বেতন-ভাতা ইএমটিএসের মাধ্যমে তাঁদের পরিবার-পরিজনের কাছে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফিও ইএমটিএসের মাধ্যমে আদায় করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের পেনশন এ সার্ভিসের মাধ্যমে বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সেবাটি চালুর পর ২০১২-১৩ অর্থবছরে ইএমটিএসের মাধ্যমে ২ হাজার ১৬১ কোটি টাকা পাঠানোর উদাহরণও তৈরি হয়েছিল। বেসরকারি এমএফএসগুলো বাজারে সক্রিয় হওয়ায় এবং টাকা পাঠানোর খরচ সময়মতো কমানোর সিদ্ধান্ত না নিতে পারায় ইএমটিএসের বাজার কিছুটা হাতছাড়া হয়। ২০১৮ সালে অবশ্য সরকার খরচ (কমিশন) কমায় ৭৩ শতাংশ।
ইএমটিএসের মাধ্যমে এক হাজার টাকা পাঠাতে আগে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা কমিশন দিতে হতো প্রেরককে। বর্তমানে তা ১০ টাকা। এমনকি ২ হাজার টাকা পাঠানোর খরচও ১০ টাকা। ডাক অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ৩ হাজার টাকা পাঠানোর খরচ ১৫ টাকা, ৫ হাজার টাকার বিপরীতে ২৫ টাকা, ৭ হাজারের বিপরীতে ৩৫ টাকা, ১০ হাজারে ৫০ টাকা, ১৫ হাজারে ৭৫ টাকা, ২০ হাজারে ১০০ টাকা এবং এভাবে ৫০ হাজার টাকা পাঠানো যায় ২৫০ টাকা খরচে।
খরচ কমের সুবিধা ভোগ করতে গেলে একটু অসুবিধাও মেনে নিতে হবে। যেমন বিকেল পাঁচটার পর টাকা জমা কিংবা উত্তোলন করা যায় না। আবার শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে বন্ধ থাকে ডাকঘর। এই সমস্যা দূর করতে ডাক অধিদপ্তর বাংলালিংকের সঙ্গে চুক্তি করলেও পরে আর কাজটি হয়নি।
ডাক অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সুশান্ত কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, কম খরচে টাকা পাঠানোর একটি ভালো মাধ্যম ইএমটিএস। ঠিকমতো পরিচর্যা করলে এই সেবার মাধ্যমে সরকার যেমন ভালো আয় করতে পারবে, সাধারণ গ্রাহকেরাও কম খরচের সুবিধাটি ভোগ করতে পারবেন।